রাস্তায় খুঁজে ফিরি সস্তায়
ঘুরে ঘুরে এক কাপ চা মেলে নাস্তায়

হ্যান্ডপেইন্টিং

হ্যান্ডপেইন্টিং- সাদাকালো ছবির উপর রং করে রঙ্গিন বানাবার একটা উপায়, যখন কালার ফিল্ম আবিষ্কার হয় নাই তখন খুব পপুলার ছিল। তার জন্য স্পেশাল রং লাগে আর সেটা বাংলাদেশে আজকাল পাওয়াও যায় না। নানা জায়গায় খুঁজে, বন্ধুদের বুদ্ধি শুনে, অ্যাক্রলিক, পোস্টার, ওয়াটার- নানা ধরনের মিডিয়াম নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করলাম। রঙগুলি হয় ওপ্যাগ, ট্রান্সপারেন্ট আউটপুটটা আসে না আর নয়তো রং স্টে করে না; মুছে যায়।

এতসব ব্যর্থতার পর, অনেক রাতে ফ্রিজ খুলে খাবার খুঁজতে গিয়ে দেখলাম ফুড কালারের ছোট ছোট শিশি। পানি মিশালেই পাতলা তরল রং, ইরা পেপারের ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট ছবিকে রঙ্গিন করার বেস্ট কালার।

বক্স ক্যামেরা:

ছবিমেলা VIII এর পরে স্কুল আবার পুরদমে শুরু হয়েছে। কিছুদিন আগে আমাদের প্রথমদিককার ক্যামেরার ফাংশন পড়ানো হয়েছে। পিনহোল ক্যামেরা বানিয়ে নানাপদের এক্সপেরিমেন্টও করে ফেলেছি।

স্কুলের পিছনের একটা ছোট জায়গায় দেখলাম ছবিমেলার অপ্রয়োজনীয় সব বোর্ড, ভাঙ্গা কাঠ-গ্লাস ফেলে রাখা। তখনি মনে হল এইসব দিয়ে একটা বক্স ক্যামেরা বানালে কেমন হয়। যেটাতে ভিউ ফাইন্ডার থাকবে, ফোকাসিংটা সহজ হবে; পিনহোলের মত আন্দাজে ঢিল মারতে হবে না। মতি ভাইকে বললাম কিছু ভাঙ্গা বোর্ড দিতে। উনি অফিসে কথা বলে যা খুশি নিয়ে যেতে বললেন। তাই করলাম। বোর্ডগুলা পাতলা প্লাস্টিকের। এন্টিকাটারে কাটতে আর ক্যামেরা বানানো হয়ে গেলে ক্যারি করতে সুবিধা হবে। পাঠশালার ছাদে কাজ শুরু করলাম, ধীরে ধীরে আরও লোকজন জুড়ে গেল, নানা ধরনের বুদ্ধি পেলাম। মনির ভাই পুরান ঢাকার একটা চশমার দোকানের ঠিকানা দিয়ে বললেন ওখানে চশমার ১০০ পাওয়ারের গ্লাস লেন্স পাওয়া যায়। সেটা বক্স ক্যামেরার ফিক্সড লেন্স হিসাবে পারফেক্ট। ট্রেসিং পেপার দিয়ে ভিউ ফাইন্ডার বানালাম। একটা মিস্ত্রিকে দিয়ে বেস বানিয়ে নিলাম যাতে ট্রাইপডে খুব সহজে দাঁড় করানো যায়। সপ্তাখানেকের খাটাখুটনিতে ক্যামেরাটা বানানো হয়ে গেল। এবার টেস্ট করবার পালা। প্রথম ছবিটা ডার্করুমেই তুলবো ঠিক করলাম, মডেল হলাম আমি, রুদ্র, আনন্দ আর নাদিম। রুদ্র-আনন্দ যমজ ভাই। নাদিম বলল ওদেরকে দিয়ে একটা ইলিউশন তৈরি করা যাবে। কয়েক সেকেন্ডের এক্সপোসার, আমরা নিজেদের পজিশনে টাইট হয়ে থাকলাম।

ডেভলপিং এর জন্য পেপার নেগেটিভটাকে ফার্স্ট ডেভলপারে চুবিয়ে হালকা হালকা নাড়ছি আর সবাই খুবি আগ্রহ নিয়ে দেখছি। ভাবছি, ছবি আসে কিনা, ক্যামেরায় কোন লিকেজ ছিল কিনা। ধীরে ধীরে ছবি পরিষ্কার হতে শুরু করল। সেটা যে কী অদ্ভুত একটা মোমেন্ট! ম্যাজিকের মত।

লেন্সের ডিসটরশনের জন্য আনন্দ ছাড়া আমাদের সবাইকে দেখে মনে হল বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছি। আনন্দের এক্সপ্রেশনটাও মনমরা, মনে হয় ও আগেই বুঝতে পেরেছিল আমরা হারিয়ে যাব।

পিনহোল ক্যামেরাঃ সেলফি

২০১৫ এর শুরুর দিকে। শীতকাল। ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে জানালো হল আমাদের কনভোকেশন হবে। আমার ইউনিভার্সিটির বন্ধুরা খুবিই এক্সসাইটেড। একটা রিইউনিওন হবে। এমনিতে দেখা করার সময় পাওয়া যায় না। সবাই এখানে ওখানে চাকরী করতে শুরু করেছে। আমি পাঠশালায় পড়ি, ফটোগ্রাফি নিয়ে খুবি সিরিয়াস। মনোযোগ দিয়ে এসাইন্টমেন্ট করি।

আব্বু-আম্মু বলল, যা সার্টিফিকেটটা তুলে রাখ। গেলাম একদিন সময় করে। এডমিন থেকে ইনফর্ম করলো আমাদের পাঁচ হাজার টাকা দিতে হবে কনভোকেশনে অ্যাটেন্ড করতে। আর এর সাথে আমাদের একটা কনভোকেশনের গাউন দেওয়া হবে, কিছু স্নাক্স। আমারতো কিছুতেই মাথায় ঢুকে না, সার্টিফিকেট নিতে টাকা দিতে হবে কেন?

আমি বললাম, ভাই, আমি শুধু সার্টিফিকেট নিব। আমার কনভোকেশন লাগবে না।

উনারা জানালেন, তবুও আমাকে টাকাটা দিতেই হবে।

গাউনটা আহামরি কিছু না। কাল রঙের, মোটা কাপড়। আমাদের দেশে যা গরম তাতে সব সময় পরাও যাবে না। কী আর করার, টাকাটা দিলাম। গাউনের সাইজ দেখে, পেপার সাইন করতে করতে উনি আমাকে জানালেন যে কাপড় যেন ঠিকঠাক থাকে। ময়লা না হয়, টুপিটা এমনকি টুপির ফিতাটাও না হারায়, ইত্যাদি। আমি আর একবার অবাক হলাম, টাকা দিয়েছি- গাউন আমার, এই লোকের এত কেয়ার কেন? উত্তর উনিই দিলেন, গাউনটা ফিরত দিতে হবে, ১৪ দিনে; কনভোকেশন শেষ হলে।

১৪ দিন একটা ড্রেস রাখবার জন্য পে করতে হবে পাঁচ হাজার টাকা? তাও আবার পরবো মাত্র একবার। আমারতো মাথায় হাত (দ্বিতীয় বারের মত, এবং দুই হাত একসাথে)। বলে কী? এটাতো রীতিমত ডাকাতি। তারমানে পার ডে এই ড্রেসের দাম পরবে তিনশ সাতান্ন টাকা চৌদ্দ পয়সা (প্রায়)। এত দামি ড্রেস আমি আমার বাপ জন্মে পরি নাই! কেনা যখন হয়ে গেছে, পরতে যখন হবেই; তখন আর দেরি না করে তক্ষনি পরে ফেললাম। বাকি ১৪ দিন আর এক সেকেন্ডের জন্যও গাউনটা খুললাম না; গোসল করলাম না, খাওয়া, শোয়া, ঘুম, ক্লাস, ছবি তুলতে বের হওয়া সবই এই গাউন পরে। টাকা যখন দিয়েছি, উসুল করা চাই।

পাঠশালার ক্লাসে, সেলফ-পোর্টেট এর এসাইন্টমেন্টে, বন্ধুদের হেল্প নিয়ে- ট্রাইপড সেট করে, কয়েক মিনিটের এক্সপোসারে নিজের একটা ছবি তুললাম। আমার প্রথম সেলফি।

(কনভোকেশনের দিনে পকেটে একটা লম্বা দড়ি নিয়ে ইউনিভার্সিটিতে গেলাম। ছবি তোলার সময়, টুপি ছুড়ে মারলে হারিয়ে গেলে যাতে ফি না দিতে হয় তাই ঠিক করেছি টুপির ফিতার সাথে বেঁধে নিব। গিয়ে দেখলাম অনেক কড়া পাহারা, প্রেসিডেন্ট এসেছেন সার্টিফিকেট দিতে। এত সব হাঙ্গামা ভাল লাগলো না। আমার সাথে আসা আমার বোন হৃদিকে নিয়ে রিক্সা করে হাতিরঝিলে ঘুরলাম, এত সুন্দর বিকালটা ঘরের ভিতর কাটানোর কোন মানে হয় না।)

পিনহোল ক্যামেরা: আমার স্কুল

আমরা বন্ধুরা মিলে কয়েকটা পিনহোল ক্যামেরা বানালাম। ২০১৪ এর দিকে। পিনহোলে পেজ (পেপার নেগেটিভ) লোড করা বা এর পরে ডেভলপ করার জন্য একটা ডার্করুম থাকা বেটার। কাজেই আমরা আমাদের স্কুলের ডার্করুম ব্যবহার করে দূরে না গিয়ে স্কুলেরই কিছু ছবি তুললাম। এগুলো কোনভাবে আমার কাছে থেকে যায়, হয়তো আমি ডেভলপ করেছিলাম তাই। তাছাড়া আমাদের জন্য কাজটা করার আনন্দটাই মূল ছিল, আউটপুটটা না। পাঠশালায় পড়ার সময়টায় আমি ভাসমান ছিলাম। কোন বাড়িতেই বেশিদিন থাকা হয় নাই। এর মধ্যে একটা বাড়িতে বন্যার পানিও উঠে। অনেক বছর পরে পুরাতন খাতা-পত্তর ঘাটতে গিয়ে কয়েকটা ছবি খুঁজে পাই। ছবিগুলাতে দাগ পরে গেছে। স্কুলটাও আর এমন নেই, ভাঙ্গা-গড়া হয়ে গেছে। পার্কিং এ পাশাপাশি রাখা মশিউর ভাইদের বাইক-স্কুটি, লোহার সিঁড়ি, পরিপাটি করে ঝাড় দেওয়া আম গাছের নিচে আমাদের দোতলার ছাদের উঠান, স্মোকিং জোন, ডার্করুম, নিচতলার বসার জায়গাটা- যেখানে সিনেমা দেখাবে বলে জো পোস্টার দিত; তার কিছুই আর নেই।

টেকনিক্যালি প্রত্যেকটা ছবিতে; ‘তোলার’ একটা ব্যাপার থাকে। ক্যামেরা যেদিকেই তাক করা থাকে, তাই আজীবনের জন্য বন্দী হয়ে যায়। পিনহোল ক্যামেরা এ বিষয়ে বেমানান। এর অভ্যাসটাই কেমন যেন খোয়া যাবার। একদিকে পিনহোলের ছোট অ্যাপারচারের জন্য অনেক ডেপথের ছবি উঠলেও লম্বা এক্সপোসার টাইমের জন্য মোশন আছে এমন কিছুই আর ধরা পরে না। তাই আমাদের জনমুখর স্কুলটাও পিনহোল ক্যামেরার কারণে সচল মানুষদের উড়িয়ে দিয়ে কেমন একটা ফাঁকা-একলা-জনমানবহীন হয়ে গেল। এখন, এতদিন পর ছবিগুলো দেখলে মনে হয়; কোথাও অনেক দূরে আমার প্রাণের স্কুলটাকে আমরা একলা ফেলে রেখে এসেছি। আর পুরাতন বাড়িটা শুধুশুধু আমার আড্ডাবাজ বন্ধুদের অপেক্ষায় বসে আছে।

সিগারেট প্যাকেটঃ

অলস দুপুরে, অনর্থক আড্ডার ফাঁকে একটা কিছুতে আঁকিবুঁকি করতে ইচ্ছে করে। ল্যান্ডফোনের দিনগুলিতে অনেকক্ষণ ধরে কথা বলবার সময়, টেলিফোন ডাইরেক্টরিতে কলম দিয়ে আম্মু যেমন নক্সা কাটতো; অনেকটা তেমন। আমার হাতের কাছে সিগারেট প্যাকেট ছাড়া আর কিছুই থাকতো না, আঁকবার, ছিড়বার জন্য। সেগুলির চামড়া ছিলে, রঙ্গিন কলম দিয়ে যা ইচ্ছা আঁকতাম। যার সাথে আড্ডা দিতে দিতে আঁকা, তাঁর ভাল লাগলে নিয়ে যেত। আর না হয় আমার ঘরের কোনায়, ড্রয়ারে গড়াতো।

ডিজিটাল পেইন্টিংঃ

মোবাইলে আঁকা ছবি। ডিজিটাল ভার্সন কই গেছে কে জানে; যে কটা প্রিন্ট করা ছিল, আছে।

নোটবুকঃ

আমি সচারচর নোটবুক কিনি না। পছন্দের কাগজ কিনে, সিলাই করি। আঠা লাগাই। কভার দেই, কাটিং মেশিনে কাটতে প্রেস-পাড়ায় ঘুরি। নিজের জন্য বানাই, আবার বন্ধুদেরও গিফট করি। এটা একটা প্রসেস, যেটা আমার খুবই আপন। বাঁধাইয়ের সরঞ্জমাদি আমার খেলনা। নোটবুকগুলি ইউস করা হয়ে গেলেও ফেলা হয় নাই, খেলনার মতই গুছিয়ে রাখি। অনেকদিন ধরেই এগুলি আমার সাথে একবাসা থেকে আরেক বাসায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। পুরাতন নোটবুক ঘাটলেই আমার লিখা-আঁকিবুঁকি-কাটাকাটি দেখা যায়। মজাই লাগে।